রাফাহ ক্রসিংয়ে অপেক্ষায় শত শত ট্রাক (বামে)- স্কাই নিউজ, গাজায় তীব্র মানবিক সংকট- আল জাজিরা
বিশ্বের সবচেয়ে বড় উন্মুক্ত কারাগার বলা হয় ফিলিস্তিনি উপত্যকা গাজা। মাত্র ৩২০ বর্গকিলোমিটারের মধ্যে বাস করে প্রায় ২৩ লাখ মানুষ। গত দুই সপ্তাহ ধরে গাজায় সর্বাত্মক অবরোধ আরোপ করেছে ইসরায়েল। হামলা চালানো হচ্ছে নির্বিচারে। বিদ্যুৎ, পানি, জ্বালানি, ওষুধ ছাড়াই জীবন কাটছে গাজাবাসীর। বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে ইন্টারনেটও। জাতিসংঘের ত্রাণ সংস্থা সতর্ক করে বলেছে যে, খাবার ও পানির অভাবে মৃত্য হতে পারে অনেক মানুষের।
গাজায় নির্বিচারে হামলা চালাচ্ছে ইসরায়েল। শত শত বসত-বাড়ি ধ্বংস করা হয়েছে। আহত হয়েছেন প্রায় ১৫ হাজার মানুষ। নিহতের সংখ্যা ৪ হাজারের বেশি। ইসরায়েলের হামলা থেকে রেহাই পায়নি হাসপাতাল, স্কুল, জাতিসংঘের ত্রাণ সংস্থার গুদাম ও নিরাপদে আশ্রয় নেওয়া মানুষও। এমন অবস্থায় গাজাজুড়ে তীব্র মানবিক সংকটের সৃষ্টি হয়েছে।
গাজার মানবিক সংকটের বিষয়ে সতর্ক করেছে আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো। গাজাবাসীর পাশে দাঁড়াতে মিশরে ত্রাণবাহী বিমান পাঠিয়েছে অনেকগুলো দেশ। সেসব ত্রাণবাহী শত শত ট্রাক অপেক্ষা করছে মিশর ও গাজার একমাত্র সীমান্ত যোগাযোগ পথ রাফাহ ক্রসিংয়ে। তবে কয়েকদিন ধরে অপেক্ষায় থাকলেও এখনও একটি ট্রাকও গাজায় প্রবেশ করতে পারেনি।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন জানিয়েছিলেন যে, শুক্রবার গাজায় ত্রাণবাহী ট্রাক প্রবেশ করবে রাফাহ ক্রসিং দিয়ে। তবে শনিবার সকাল পর্যন্ত এখনও কোনো ট্রাক গাজায় প্রবেশ করেনি। এ বিষয়ে জেনেভায় জাতিসংঘের মানবিক প্রধান মার্টিন গ্রিফিতকে উদ্ধৃত করে মুখপাত্র জেন্স লায়ের্ক বলেছেন, গাজায় যত দ্রুত সম্ভব ত্রাণ সরবরাহ নিশ্চিত করতে আমরা সংশ্লিষ্ট সব পক্ষের গভীর ও অগ্রিম আলোচনা করছি। প্রথম চালান আগামী দিন বা তার পরে শুরু হতে পারে।
গাজার আল শিফা হাসপাতালের পরিচালক মোহাম্মদ আবু সেলমিয়া আরও দুই দিন আগে জানান যে, হাসপাতালের মেঝেতে রাখা হয়েছে। রক্তাক্ত মেঝেতে অবশ করা ছাড়াই রোগীদের অপারেশন করতে হচ্ছে। এটি হৃদয়বিদারক।
আবু সেলমিয়া বলেন, “আমাদের যন্ত্রপাতি দরকার, ওষুধ দরকার, বিছানা দরকার, অ্যানেস্থেশিয়া দরকার, আমাদের সবকিছু দরকার। হাসপাতালের জেনারেটরের জ্বালানীও একেবারে শেষের দিকে।”
ইসরায়েল শুরু থেকেই সাধারণ মানুষের ওপর হামলা করছে। জাতিসংঘের স্কুল, হাসপাতাল, আশ্রয়কেন্দ্র এমনকি জাতিসংঘের ত্রাণ সংস্থার গুদামেও বোমা ফেলেছে ইসরায়েল। এসব তথ্য জানিয়েছে, হিউম্যান রাইটস ওয়াচ, জাতিসংঘের ফিলিস্তিনি শরণার্থী সংস্থা, রেডক্রসসহ অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংস্থা।
সম্প্রতি এক প্রতিবেদনে এপি জানায়, গাজা উপত্যকায় বিশুদ্ধ পানির অভাব স্বাস্থ্যের জন্য বড় উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ফিলিস্তিনিদের জন্য জাতিসংঘের সংস্থার প্রধান ফিলিপ লাজারিনি বলেছেন, “গাজার পানি ফুরিয়ে যাচ্ছে এবং গাজার জীবন ফুরিয়ে যাচ্ছে।”
নিত্যপ্রয়োজনীয় সবকিছুর সংকটে পড়েছে ফিলিস্তিনের প্রায় ২৩ লাখ মানুষ, যাদের অর্ধেকই বাস্তুচ্যুত। পানি নেই, ৪ হাজার মানুষের জন্য চারটি টয়লেট। মেঝেতে বা মাটিতেই তারা ঘুমাচ্ছে। আমরা (খাদের) কিনারে চলে এসেছি।
ইউএনআরডব্লিউএ এর প্রধান ফিলিপ্পে লাজারিনি
গাজা সাধারণত ইসরায়েল থেকে পাইপলাইন, ভূমধ্য সাগরে ডিস্যালিনেশন প্ল্যান্ট এবং কূপসহ কয়েকটি উৎস থেকে খাবার ও ব্যবহারের পানি পায়। ৭ অক্টোবরে হামাসের হামলার পর ইসরায়েল বিদ্যুৎ, জ্বালানিসহ সর্বাত্মক অবরোধ আরোপ করেছে গাজায়। জ্বালানির অভাবে সেখানকার একমাত্র বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ হয়ে গেছে। এর ফলে পানির উৎসগুলো থেকে পানি সংগ্রহও হ্রাস পেয়েছে।
জাতিসংঘ বলছে, পানি সরবরাহ মানবাধিকারের অংশ এবং এটি মৌলিক চাহিদার একটি। মানুষের বেঁচে থাকার জন্য পানির সরবরাহ প্রয়োজন।
মধ্যপ্রাচ্যের ভূ-রাজনীতিকে কেন্দ্র করে গাজা সংকটে বিশ্ব নেতাদের ভিন্ন ভিন্ন অবস্থানের ঊর্ধ্বে ‘মানবিক বোধটা’ যে জরুরি সে কথা মনে করিয়ে দিয়ে ফিলিস্তিনে জাতিসংঘের ত্রাণ সংস্থা ইউএনআরডব্লিউএ এর প্রধান ফিলিপ্পে লাজারিনি বলেন, “বিশ্ব এখন মানবতা হারাচ্ছে।”
তিনি বলেন, “আমি বিশ্বাস করি না যে, এই অঞ্চলের ভবিষ্যৎ নিরাপত্তা ও শান্তির স্বার্থে এতো মানুষ হত্যা। আমরা এখন এমন একটি পরিস্থিতিতে আছি, যেখানে গাজা ভূখণ্ডে সম্পূর্ণ অবরোধ আরোপ করা হচ্ছে। এমন একটি পরিস্থিতিতে আছি, যেখানে ১০ লাখেরও বেশি মানুষকে বাস্তুচ্যুত বা ঘড়বাড়ি ছাড়তে বলা হয়েছে। ফলে এটি হল সম্মিলিত শাস্তি, যেটি আন্তর্জাতিক মানবিক আইনের লঙ্ঘন।”
ফিলিপ্পে লাজারিনি বলেন, “আমরা ইসরায়েল ও এই সংঘাতের সঙ্গে জড়িত সকলকে আন্তর্জাতিক মানবিক আইনের প্রতি সম্মান দেখানোর আহ্বান জানাচ্ছি। সংঘাতে জড়িত যে কারও জন্য এর ব্যতিক্রম নয়।”
শুক্রবার রাফাহ ক্রসিং পরিদর্শন করেছেন জাতিসংঘের মহাসচিব অ্যান্তনিও গুতেরেস। এ সময় তিনি সেখানে থাকা শত শত ত্রাণবাহী ট্রাক গাজায় দ্রুত পাঠানোর অনুরোধ করেছেন। গাজায় জরুরি ত্রাণ সহায়তা পৌঁছানোর জন্য নিঃশর্ত যুদ্ধবিরতির আহ্বান জানিয়েছেন জাতিসংঘ মহাসচিব।
গুতেরেস বলেন, গাজায় মানবিক সহায়তা প্রবেশের জন্য যেসব শর্ত দেওয়া হয়েছে জরুরি ত্রাণ পৌঁছানোর স্বার্থে ওই শর্তগুলো প্রত্যাহার করা উচিত।”
ফিলিস্তিনের গাজা উপত্যকায় ইসরায়েল কোনো ত্রাণ প্রবেশ করতে দিচ্ছে না বলে অভিযোগ করেছে মিশর। শুক্রবার দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র মাইক্রো ব্লগিং সাইট এক্সে এক পোস্টে দাবি করেছেন, ইসরায়েল ত্রাণবাহী ট্রাক প্রবেশে বাধা দিলেও ‘পশ্চিমা সংবাদমাধ্যমগুলো’ গাজায় মানবিক বিপর্যয়ের জন্য মিশরকে টার্গেট করে মিথ্যা সংবাদ প্রকাশ করছে।
গাজার মানবিক সংকটের তীব্রতা উল্লেখ করে ইউএনআরডব্লিউএ এর কমিশনার জেনারেল ফিলিপ্পে লাজারিনি বলেন, “নিত্যপ্রয়োজনীয় সবকিছুর সংকটে পড়েছে ফিলিস্তিনের প্রায় ২৩ লাখ মানুষ, যাদের অর্ধেকই বাস্তুচ্যুত। পানি নেই। ৪ হাজার মানুষের জন্য চারটি টয়লেট। মেঝেতে বা মাটিতেই তারা ঘুমাচ্ছে। আমরা (খাদের) কিনারে চলে এসেছি। পানি না থাকলে গাজায় সংকট আরও বাড়বে। আমাদের চোখের সামনে বিপর্যয় ঘটছে, সেটি আরও তীব্র হবে।”
গাজার ২৩ লাখ বাসিন্দার মধ্যে দশ লাখের বেশি মানুষ অভ্যন্তরীণভাবে বাস্তুচ্যুত হয়েছেন। প্রতি দিন অবস্থার আরও অবনতি হচ্ছে।
জাতিসংঘ
যুদ্ধ পরিস্থিতিতে গাজায় সাহায্য পাঠানো না গেলে সেখানে মানবিক বিপর্যয় ঘটবে বলে আগেই সতর্ক করেছে জাতিসংঘ। গত ৭ অক্টোবর ইসরায়েলে হামাসের হামলার আগে প্রতিদিন ত্রাণ সাহায্য নিয়ে ৫০০ ট্রাক প্রবেশ করত গাজায়। জ্বালানিসহ অন্যান্য ত্রাণ পৌঁছে দিত ট্রাকগুলো।
কিন্তু চরম সংকটময় পরিস্থিতিতে এখন কী পরিমাণ সাহায্য দরকার এবং কী পরিমাণ সাহায্য পাঠানোর অনুমতি দেওয়া হয়েছে সেটি অস্পষ্ট বলে জানান ইউএনআরডব্লিউএ প্রধান। তবে গাজাবাসীর জন্য এখন অন্তত প্রতিদিন ১০০ ট্রাক সাহায্য পাঠানো প্রয়োজন বলে মনে করেন তিনি।
জাতিসংঘ বলেছে, গাজার ২৩ লাখ বাসিন্দার মধ্যে দশ লাখের বেশি মানুষ অভ্যন্তরীণভাবে বাস্তুচ্যুত হয়েছেন। প্রতি দিন অবস্থার আরও অবনতি হচ্ছে।