পাকিস্তানের পার্বত্য অঞ্চল বেলুচিস্তানে ইরানের হামলার পর দুই দেশের মধ্যে চলছে চরম উত্তেজনা। ইরান বলছে— ইসলামাদের ‘উগ্রগোষ্ঠীর ঘাঁটি’ লক্ষ্য করে মিসাইল ও ড্রোন হামলা চালিয়েছে তেহরান। দুই শিশু নিহতের ওই ঘটনাকে কেন্দ্র করে ঘটেছে রাষ্ট্রদূত তলব, বহিষ্কার ও প্রত্যাহারের ঘটনাও। এতেই থামেনি পাকিস্তান, প্রতিশোধমূলক হামলা চালিয়েছে ইরানে। তবে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ প্রতিবেশী দুই ‘ভ্রাতৃপ্রতিম ও বন্ধু’ দেশের পাল্টাপাল্টি হামলার ঘটনায় বিস্মিত হয়েছেন অনেকে। প্রশ্ন উঠছে— তবে কি চলমান রাশিয়া-ইউক্রেন, ইসরায়েল-ফিলিস্তিন যুদ্ধের মধ্যেই আরও একটি যুদ্ধের দামামা বাজল?
ইতিহাস বলছে— পাকিস্তান ও ইরানের মধ্যে ঐতিহাসিক কিছু বিরোধ রয়েছে। এর একটি বড় কারণ হচ্ছে ধর্ম। ইরান মূলত একটি শিয়া-পন্থী রাষ্ট্র। অন্যদিকে পাকিস্তান সুন্নি মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ। বিভিন্ন সময় শিয়া-সুন্নির উত্তেজনাকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন হত্যাকাণ্ডও হয়েছে। ফলে দুই দেশের সম্পর্ক সবসময় একটা চড়াই-উতরাইয়ের ভেতর দিয়ে গেছে। যদিও ২০২১ সাল থেকে এই সম্পর্ক অনেকটাই স্থিতিশীল।
ইরান কেন আক্রমণ করেছে?
তেহরান মনে করে পাকিস্তানের বেলুচিস্তান থেকে উগ্রবাদীরা এসে ইরানের সিস্তান-বেলুচিস্তান প্রদেশে হামলা করছে। অন্যদিকে পাকিস্তানও মনে করে, বালুচ বিচ্ছিন্নতাবাদীদের সমর্থন যোগাচ্ছে ইরানের গোয়েন্দারা। পাকিস্তান অংশে বালুচরা আলাদা একটি দেশ গঠন করতে চায়।
গত বছর ইরানের ভেতরে বেশ কয়েকটি হামলা হয়েছে। গত ডিসেম্বর মাসে সর্বশেষ হামলায় ইরানের একটি পুলিশ স্টেশনে অতর্কিত আক্রমণে ইরানের ১১ জন নিরাপত্তাকর্মী নিহত হয়েছে। সে সময় ইরানের কর্মকর্তারা দাবি করেছিলেন, এসব হামলাকারীরা পাকিস্তানের ভেতর থেকে এসেছিল।
একইভাবে পাকিস্তানের ভেতরেও গত বছর দুটো আক্রমণ হয়েছিল যেখানে বেশ কয়েকজন পাকিস্তানি সেনা মারা যায়। এই হামলার উৎপত্তিস্থল ইরানের ভেতরে ছিল বলে পাকিস্তান মনে করে। যদিও সীমান্তের ভেতরে ‘উগ্রবাদীদের কার্যক্রম’ দেশ দুটির জন্য অস্বস্তির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
দ্বিতীয় কারণটি হচ্ছে শিয়া-সুন্নি বিরোধ। পাকিস্তানে বিভিন্ন সময় শিয়াদের লক্ষ্য করে নানা ধরনের হামলা হয়। এ বিষয়টি ইরানের মধ্যে একটি চাপা ক্ষোভ তৈরি করেছে বহুদিন ধরে। পাকিস্তানের পশ্চিমাঞ্চলে মসজিদে যখন কোনো বোমা হামলা হয় তখন সেটি শিয়াদের বিরুদ্ধে হয়।
কুয়ালালামপুরে মালয় ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক ও সমর বিশেষজ্ঞ সৈয়দ মাহমুদ আলী মনে করেন, বিভিন্ন চাপের কারণে পাকিস্তান ও ইরানের মধ্যে সম্পর্ক দৃশ্যত ভালো মনে হতো। কিন্তু ভেতরের পরিস্থিতি আসলে সে রকম নয়। তিনি বলেন, ইরান ও পাকিস্তান পরস্পরের মধ্যে একটা ‘রাজনৈতিক সম্পর্ক‘ বজায় রেখে চলেছে।
সম্প্রতি ইসরায়েলের গুপ্তচর সংস্থা মোসাদের ‘গোপন আস্তানা’ টার্গেট করে ইরান মিসাইল হামলা চালিয়েছে সিরিয়ার ইদলিবে এবং ইরাকের কুর্দিস্থানে। এছাড়াও লোহিত সাগরে ইসরায়েলের সাথে সম্পর্কিত জাহাজে হুথি বিদ্রোহীরা সেসব হামলা চালাচ্ছে তাতে ইরানের সংযোগ আছে বলে মনে করে পশ্চিমারা।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, গত কয়েকদিনের মধ্যে ইরান একাধিক হামলায় জড়িয়েছে কেন?
গত কয়েক বছর ধরে ইরানের বিরুদ্ধে নানা তৎপরতা চালাচ্ছে আমেরিকা ও ইসরায়েল। ইরানের ভেতরে এবং বাইরে অনেক আক্রমণ হয়েছে। ইরানের শীর্ষ কমান্ডার কাশেম সোলাইমানিকে আমেরিকা হত্যা করেছে ইরাকের মাটিতে।
অন্যদিকে ইরানের ভেতরে দেশটির শীর্ষ পরমাণু বিজ্ঞানী আহমেদ ফখরেজাদেকে হত্যা করা হয়েছে। এজন্য ইরান অভিযুক্ত করেছে ইসরায়েলকে। তাছাড়া পাকিস্তান সীমান্তেও ইরানবিরোধী নানা তৎপরতা চলছে।
মাহমুদ আলী বলেন, ইরান একটা বার্তা দিতে চাচ্ছে। তারা তাদের সাধ্যমতো লড়াই করবে। ইরান রাষ্ট্রকে জনসাধারণের কাছে প্রমাণ করতে হবে যে তারা দেশের স্বার্থরক্ষা করতে পারে এবং তাদের সেই সামর্থ আছে।
ইরানি পর্যবেক্ষকরাও মনে করেন, পাকিস্তানের সাথে সংঘাত বাড়ানো ইরানের জন্য ঠিক হবে না। বিবিসি পার্সিয়ান ওয়েবসাইটে মোহাম্মদ ওয়াজিরি এক নিবন্ধে লিখেছেন, ইরান ও পাকিস্তানের মধ্যে নানাবিধ সমস্যা থাকলেও এদুটো দেশ পরষ্পরের ঘনিষ্ঠ।
সেজন্য বুধবার ইরান যে হামলা চালিয়েছে সেটি নিয়ে নানা প্রশ্ন উঠছে। আফগানিস্তান নিয়ে পাকিস্তানের যেমন সমস্যা ছিল, তেমনি ইরানেরও সমস্যা ছিল। ভারতের সাথে সীমান্তে পাকিস্তানের সমস্যা রয়েছে। অন্যদিকে ইরানেরও তাদের পশ্চিম সীমান্ত নিয়ে সমস্যা রয়েছে। এসব কারণে পাকিস্তান ও ইরান সীমান্তে বড় ধরনের উত্তেজনা তৈরি থেকে দুদেশের বিরত থাকা প্রয়োজন বলে মন্তব্য করেছেন মোহাম্মদ ওয়াজিরি।
পাকিস্তানের ভাবনা কী?
পাকিস্তানের সাবেক কূটনীতিক ও পর্যবেক্ষকরা মনে করেন, সীমান্তে উগ্রবাদী কার্যক্রমের যে সমস্যা আছে সেটি দুই দেশ একত্রে কাজ করে দূর করতে পারে। কোনো একটি পক্ষ থেকে একতরফা কাজ করে এই সমস্যার সমাধান করা যাবে না।
পাকিস্তানের পর্যবেক্ষকরা বলছেন— ইরানের সাথে সম্পর্কের যাতে অবনতি না হয় সেটিকে দৃষ্টি দেওয়ার কথা। তারা মনে করেন, সীমান্ত সমস্যা নিয়ে ইরানকে ভারতের কাতারে ফেলা ঠিক হবে না।
পাকিস্তানের সাবেক পররাষ্ট্র সচিব আইজাজ আহমাদ চৌধুরী জানিয়েছেন, পাকিস্তান দায়িত্বশীলতার সাথে কাজ করেছে। জবাব দেওয়ার মাধ্যমে পাকিস্তান প্রমাণ করেছে যে তারা এটা করতে চায় না, তবে চাইলে তারা করতে পারে। ভারত এবং আফগানিস্তানের সাথে পাকিস্তানের সীমান্ত ভালো নয়। সেজন্য পাকিস্তানের উচিত হবে না আরেকটি সীমান্তে বিবাদ তৈরি করা। তিনি মনে করেন, পরিস্থিতি যাতে আরও খারাপের দিকে না যায় সেজন্য দুদেশের উচিত হবে পরিপক্কভাবে এই সমস্যার সমাধান করা।
পাকিস্তানের ডন পত্রিকায় এক সম্পাদকীয়তে বলা হয়েছে, অনেক বিদেশি শক্তি দেখতে চায়, পাকিস্তান এবং ইরানের মধ্যে যে সম্পর্ক রয়েছে সেটি স্থায়ীভাবে ভেঙে যাক।
সাবেক প্রতিরক্ষামন্ত্রী খাজা আসিফ বলেছেন, পাকিস্তান যে ‘নিয়ন্ত্রিত’ জবাব দিয়েছে সেটি তেহরানের মাঝে ‘উদ্বেগ’ সৃষ্টি করবে। ইরানের ভেতরে আঘাত করার মাধ্যমে পাকিস্তান একটি সীমা অতিক্রম করেছে, যেটি লঙ্ঘন করার ব্যাপারে আমেরিকা এবং ইসরায়েলও সবসময় সতর্ক থাকে।
ওয়াশিংটনের উইলসন সেন্টারের সাউথ এশিয়ান স্কলার মাইকেল কুগেলম্যান মনে করেন, ইরানের হামলার বিপরীতে পাকিস্তান সমানভাবে জবাব দিয়েছে। পাকিস্তানের হামলায় শুধু উগ্রগোষ্ঠীকে টার্গেট করা হয়েছে, ইরানের নিরাপত্তা বাহিনীকে টার্গেট করা হয়নি। বলতে গেলে এটা এখন দুই দেশের মধ্যে উত্তেজনা কমানোর রাস্তা খুলবে, যদি উভয় পক্ষ মাথা ঠাণ্ডা রাখতে পারে। কিন্তু এখানে বড় একটা ‘যদি’ আছে।
যুদ্ধের দিকে গড়াবে?
পর্যবেক্ষকরা মনে করছেন— ইরান ও পাকিস্তানের মধ্যে যা ঘটেছে সেটা এটা শক্তি প্রদর্শনের হামলা। কাউকে ধরাশায়ী করার জন্য নয়। এটা একটা রাজনৈতিক বার্তাও বটে।
সৈয়দ মাহমুদ আলী বলেছেন— আপনি যে আপনার বৈরি রাষ্ট্রের সীমান্ত অতিক্রম করে হামলা চালাতে পারেন, এটা সে বার্তা দিচ্ছে নিজ দেশের জনগণ ও বৈরি রাষ্ট্রর প্রতি। তিনি আশঙ্কা করছেন, উভয় দেশ পরস্পরের প্রতি তাদের সামর্থ দেখাতে চাইছে। পাকিস্তানের পাল্টা হামলার পর ইরান যদি আবারও আক্রমণ করে তাহলে পাকিস্তানও জোরালো আক্রমণ করবে। সেক্ষেত্রে সংঘাত ছড়িয়ে যেতে পারে।
তিনি বলেন, আপনি আমাকে একটা ঘুষি মেরেছেন, আমি আপনাকে পাল্টা আরেকটা ঘুষি মেরেছি। এই শক্তি প্রদর্শনের বিষয়টা যদি ওখানে শেষ হয়ে যায়, তাহলে ব্যাপারটা এখানেই শেষ হয়ে যাবে। তিনি মনে করেন, এখন বিষয়টি ইরানের হাতে। ইরান যদি আবারও হামলা চালায় তাহলে সংঘাত ছড়িয়ে যাবে। তার মতে— ইরান ও পাকিস্তান সংঘাত ছড়িয়ে গেলে আমেরিকা পাকিস্তানকে সমর্থন দেবে।
চীন কোন দিকে যাবে?
ইরান-পাকিস্তান – উভয় দেশের ঘনিষ্ঠ মিত্র হচ্ছে চীন। পাকিস্তানে চীনের বিভিন্ন বিনিয়োগ রয়েছে এবং দুই দেশের মধ্যে সামরিক সহযোগিতাও বহু পুরনো। তাছাড়া পাকিস্তান ও চীন – দুই দেশ ভারতের প্রতিপক্ষ। এটিও তাদের অভিন্ন স্বার্থ। চীনের সহযোগিতায় পাকিস্তান বেলুচিস্তানে বিভিন্ন খনিজ পদার্থ আহরণ ও বন্দর নির্মাণের কাজ করছে।
অন্য দিকে চীনের মধ্যস্থতায় সম্প্রতি ইরান ও সৌদি আরবের মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্ক পুনরায় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। যদিও ইরান এবং সৌদি আরব পরস্পরের চরম প্রতিপক্ষ। কিন্তু দুই দেশের মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্ক পুনরায় প্রতিষ্ঠিত করার মতো জটিল কাজটি করতে পেরেছে চীন। এতে করে বোঝা চাচ্ছে, ইরানের ওপরও চীনের প্রভাব রয়েছে। সে ক্ষেত্রে অনেকে চীনের ভূমিকাকে গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে দেখছে। এই সমস্যা দূর করার জন্য চীন ভূমিকা রাখতে পারে বলে উল্লেখ করা হয়েছে ডন পত্রিকার সম্পাদকীয়তে।
চীন কোনোভাবেই চাইবে না পাকিস্তান ও ইরানের মধ্যে বড় ধরনের সংঘাত তৈরি হোক। চীনের স্বার্থ হচ্ছে এই অঞ্চলকে শান্ত রাখা। ইরান এবং পাকিস্তান – এই দুটো দেশ চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভের সাথেও ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত।
ইরানের বন্দর আব্বাস এবং পাকিস্তানের বেলুচিস্তান প্রদেশে গোয়াদার বন্দরের সাথে সংযোগের মাধ্যমে চীন তাদের ‘বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভের’ অংশ হিসেবে ব্যবসা বাণিজ্যের বড় একটি রুট গড়ে তুলছে। ফলে ইরান এবং পাকিস্তানের মধ্যে সংঘাত হলে চীনের ব্যাপক স্বার্থহানি হবে।
সৈয়দ মাহমুদ আলী, সে জন্য চীন উভয় দেশের মধ্যে সংঘাত থামানোর চেষ্টা করবে। চীন এখানে ভূমিকা রাখলে ইরান ও পাকিস্তান শান্ত হয়ে আসার সুযোগ পাবে।
পাকিস্তানের সাবেক পররাষ্ট্র সচিব আইজাজ আহমাদ চৌধুরী জিও নিউজকে বলেন, ইরান এবং পাকিস্তান – এ দুটো দেশ চীনের সহায়তায় নিজেদের মধ্যে আলোচনা শুরু করে বিরোধ নিষ্পত্তি করতে পারে।
উল্লেখ্য, সিস্তান-বেলুচিস্তান ইরানের একটি প্রদেশ। এর ঠিক পাশেই রয়েছে পাকিস্তানের বেলুচিস্তান প্রদেশ। ব্রিটিশ শাসনামলের শেষে দিকে পাকিস্তানের বেলুচিস্তানকে দুটি অংশে ভাগ করা হয়। যার একটি অংশ ইরানের অধীনে চলে যায়। সূত্র: বিবিসি