তৎকালীন আরবের কুরাইশ ব্যবসায়ীদের প্রতি বছর একবার শামে যাওয়ার প্রথা ছিল। শাম হলো বর্তমান সিরিয়া, ফিলিস্তিন, লেবানন ও জর্ডান অঞ্চল। রেওয়াজ অনুযায়ী, কোনো একবছর নবীজির চাচা আবু তালিব শাম যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হলেন। তখন প্রিয়নবী (স.)-এর বয়স ১২ বছর। তাঁকে সঙ্গে নেওয়ার কোনো চিন্তাভাবনা না থাকলেও ভাতিজার বিষণ্ন মুখ দেখে আবু তালেব মুহাম্মদ (স.)-কে কাফেলার সঙ্গি করতে বাধ্য হন।
ব্যবসায়ী কাফেলা তৎকালীন সিরিয়ার নিকটবর্তী বুসরা নামক স্থানে পৌঁছালে যাত্রাবিরতি করে। সেখানে বুহাইরা বা বাহিরা নামক একজন খ্রিস্টান পাদরির সঙ্গে তাঁদের সাক্ষাৎ হয়।
বহু বছর ধরে বাহিরা বুসরায় অবস্থিত তাঁর বিশেষ মঠে উপাসনায় নিয়োজিত ছিলেন। তিনি খ্রিস্টান ধর্ম সম্পর্কে গভীর জ্ঞানের অধিকারী ছিলেন এবং সেই এলাকার খ্রিস্টানরা তাঁকে অনেক সম্মানের চোখে দেখতেন। অনেক সময় বাণিজ্য কাফেলা ওই স্থানে যাত্রাবিরতি করত এবং কাফেলার সদস্যরা আশীর্বাদ পাওয়ার জন্য তাঁর কাছে যেতেন।
মক্কার ব্যবসায়ী-দল যখন বুসরায় শিবির স্থাপন করেন, তখন পাদরি বাহিরা গির্জা থেকে বেরিয়ে তাঁদের কাছে আগমন করেন এবং সবাইকে আতিথেয়তায় আপ্যায়িত করেন; এর আগে কখনো তিনি গির্জা থেকে বেরিয়ে কোনো বাণিজ্যিক কাফেলার সঙ্গে এভাবে সাক্ষাৎ করেননি। পাদরি কিশোর মুহাম্মদ (স.)-এর অবয়ব, আচরণ ও অন্যান্য বৈশিষ্ট্য লক্ষ করেন এবং তিনি তাঁর মধ্যে আখেরি নবীর নিদর্শন দেখতে পান।
শিশু মুহাম্মদ (স.)-এর রহস্যময় এবং গভীর চেহারা তার হৃদয়ে লুকিয়ে থাকা রহস্যকে রেখাপাত করে। তিনি কয়েক মুহূর্ত নবীজির দিকে তাকিয়ে রইলেন। এরপর হঠাৎ নীরবতা ভেঙে জিজ্ঞেস করলেন, ‘ছেলে! কার সাথে তোমার সম্পর্ক?’ উপস্থিত কয়েকজন লোক তাঁর চাচার দিকে তাকাল। তখন আবু তালিব বললেন, সে আমার ভাতিজা। তখন বাহিরা বললেন, ‘এই ছেলেটার একটা উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ আছে। তিনি সেই প্রতিশ্রুত নবী, যার সার্বজনীন নবুয়ত, বিজয় ও শাসনের কথা আসমানি কিতাবে ভবিষ্যদ্বাণী করা হয়েছে। আমি কিতাবসমূহে যে নিদর্শনগুলো পড়েছি তা কেবল এই শিশুর সাথেই প্রযোজ্য। তিনি সেই নবী, যাঁর নাম, পিতার নাম এবং পরিবার সম্পর্কে আমি পড়েছি এবং আমি জানি তিনি কোথা থেকে অগ্রসর হবেন এবং তাঁর দ্বীন পৃথিবীতে কীভাবে ছড়িয়ে পড়বে।
এ বিষয়ে সিরাতের কিতাবে উল্লেখ রয়েছে, পাদরি বুহাইরা তখন রাসুলুল্লাহ (স.)-এর হাত ধরে বলেন, ‘ইনি সাইয়েদুল আলামিন (জগৎগুলোর নেতা)। আল্লাহ তাঁকে বিশ্ববাসীর জন্য রহমত বা অনুগ্রহ হিসেবে প্রেরণ করেছেন।’ তিনি আবু তালিবকে পরামর্শ দেন যেন নবীজিকে সিরিয়ায় না নেওয়া হয়। কেননা তাতে ইহুদিরা মুহাম্মদ (স.)-এর ক্ষতি করতে পারে। বুহাইরার পরামর্শ অনুযায়ী, আবু তালিব তাঁকে মক্কায় ফেরত পাঠান। (আর-রাহিকুল মাখতুম, পৃষ্ঠা-৭৫)
সিরাতে মুস্তফায় ঘটনাটি এভাবে এসেছে—পাদ্রি তাঁর হাত ধরে বলেন, ‘ইনি হচ্ছেন বিশ্ব জাহানের সর্দার। আল্লাহ তাঁকে বিশ্ব জাহানের রাসুল মনোনীত করবেন।’ তখন কাফেলার লোকজন বলেন, ‘আপনি কিভাবে নিশ্চিত হলেন যে তিনিই সর্বশেষ নবী?’ বললেন, ‘তোমাদের আগমনের সময় দূর থেকে আমি প্রত্যক্ষ করেছি যে এমন কোনো বৃক্ষ কিংবা প্রস্তরখণ্ড বাকি ছিল না, যা এই কিশোরকে সেজদা করেনি। আর এসব সৃষ্টিরাজি নবী-রাসুল ছাড়া অন্য কাউকে কখনো সেজদা করে না। তার কাঁধের নিচে ‘মোহরে নবুয়ত’ দেখেও আমি তাঁকে চিনতে পেরেছি। আমাদের ধর্মগ্রন্থ বাইবেল সূত্রে আমরা এসব তথ্য আগেই পেয়েছিলাম।’ (সিরাতে মুস্তফা: ১/১১৬-১১৭)