চলমান অত্যধিক তাপমাত্রায় (Heat wave) দিনের পর দিন বাইরে থাকলে বা কাজ করলে হিট এক্সহশন বা হিট স্ট্রোক হয়ে যাবার সম্ভাবনা খুব বেশি।হিট স্ট্রোক একটা মেডিকেল ইমার্জেন্সি এবং অতি দ্রুত বিশেষায়িত (Specialised)মেডিকেল ফ্যাসিলিটি তে না নিয়ে গিয়ে চিকিৎসা করালে মৃত্যুর সম্ভাবনা খুব বেশি।
এই গরমে বেশিক্ষণ বাইরে থাকার কারণে শরীরের তাপমাত্রা বেড়ে যায়।আমাদের শরীর খুব তাপমাত্রা সংবেদনশীল।তাপমাত্রা বাড়তে থাকলে আমাদের শরীর বিভিন্ন ভাবে তাপমাত্রা কমাতে কাজ শুরু করে দেয়।প্রধানতম পদ্ধতি হচ্ছে ঘাম তৈরী করে।যখন আমাদের বডির সারফেস থেকে ঘাম বাষ্পীভূত(Evaporated) হয়ে শুকায় – তা আমাদের শরীরের তাপমাত্রা কমিয়ে আনে।
তবে এই ঘামের মাধ্যমে তাপমাত্রা কমানোর একটা লিমিটেশন আছে! হিউমিডিটি(Humidity)বা বাতাসের আদ্রতা যদি ৭৫ % এর বেশি হয় তাহলে এই পদ্ধতি খুব একটা কাজ করে না।
আমরা যদি ধাপে ধাপে ব্যাখ্যা করি – অতিরিক্ত গরমের কারণে কি কি সমস্যা গুলো হতে পারে তা হবে –
প্রথম ধাপে যা হয় তা হচ্ছেঃ
১.হিট ক্রাম্প(Heat Cramp)অতিরিক্ত ঘামের কারণে লবন ও পানির অভাব হয় এবং এর প্রভাবে মাসল ( বিশেষ করে পায়ের) মাসল ক্র্যাম্প (কামড়ানো) শুরু করে!
২.তাপমাত্রা জনিত মুর্ছা(Heat syncope)
অতিরিক্ত তাপমাত্রায় দীর্ঘ সময় দাঁড়িয়ে থাকলে,রক্ত নালীর প্রসারণের জন্য রক্তচাপ কমে গিয়ে আপনার মুর্ছা(Faint)হতে পারে।এটি হচ্ছে হিট সিনকোপ
এর পর হচ্ছেঃ
৩.হিট এক্সহশন(Heat exhaustion)এক দফায় হিট এক্সপোজার এর কারণে না হয়ে অনেক দিনের ক্রমাগত অধিক তাপমাত্রা(High ambient temperature)এক্সপোজারের কারণেও হতেও পারে।যেমন আপনি পর পর তিন চারদিন দুতিন ঘন্টা করে বাইরে গরমে থাকলেন,তারপর পাঁচদিন এর দিন আপনার হিট এক্সহশন এর উপসর্গশুরু হলো! যারা বয়স্ক, যারা অতিরিক্ত শুকনা(Undernourished), স্থুল(Obese), শিশু, প্রেগন্যান্ট এবং যাদের উচ্চ রক্তচাপ আছে – এরাই বেশি ঝুঁকিপূর্ণ।
হিট এক্সহশন এর লক্ষণ হচ্ছে অতিরিক্ত ঘাম হওয়া, দুর্বলতা, মাথা ধরা, মাথা ব্যাথা, বমিবমি ভাব আর ফেইন্ট ভাব হওয়া।থার্মোমিটার দিয়ে শরীরের তাপমাত্রা মেপে দেখতে পারেন হিট এক্সহশন কনফার্ম করার জন্য।হিট এক্সহশন এর এক পর্যায়ে শ্বাস প্রশ্বাস ও হার্ট রেট দ্রুত হতে শুরু করবে।
কিভাবে চিকিৎসা করবেন হিট এক্সহশন?
প্রথম কাজ – ছায়ায় নিয়ে আসুন রুগীকে।রিহাইড্রেশন করুন।খাবার স্যালাইন(Oral Rehydration Saline-ORS) সবচেয়ে ভালো।শুধু ঠান্ডা পানি হয়েও চলবে প্রথমে! আসে পাশে পুকুর থাকলে গলা পর্যন্ত পুকুরের পানিতে নামিয়ে দিন।পুকুর না থাকলে বাথটাবে শুইয়ে দিন এবং পানির মধ্যে কিছু বরফ ঢেলে দিন! তাও না থাকলে ঠান্ডা পানিতে গোসল করিয়ে দিন তারপর টেবিল ফ্যান দিয়ে শরীর শুকিয়ে দিন – টেম্পারেচার না নামলে আবার ঠান্ডা পানিতে গোসল করতে দিন এবং ম্যাক্স স্পিড টেবিল ফ্যান দিয়ে শরীর শুকিয়ে দিন।
মনে রাখতে হবে ঠান্ডা পানির রিহাইড্রেশন খুব জরুরি।তবে এটাও মনে রাখতে হবে শুধু পানি অতিরিক্ত খাওয়া ক্ষতিকর হতে পারে।সে জন্য খাবার স্যালাইন উপকারী।
৪.হিট স্ট্রোক(Heat stroke)
যদি হিট এক্সহশন এর ঠিকমতো চিকিৎসা করা না যায় – অথবা ডায়াগনোসিস করা না যায় তবে হিট স্ট্রোক(Heat stroke)হয়ে যাবার সম্ভাবনা খুব বেশি।
যদি দেখেন স্কিন শুকনা লাল হয়ে গিয়েছে; ঘাম হচ্ছে না – পালস হাই হয়ে গিয়েছে – রুগী উল্টা পাল্টা কথা বলছে অথবা কোন কথা বলছে না অথবা রুগী অজ্ঞান হয়ে যাচ্ছে – হিট স্ট্রোক সন্দেহ করুন।এর পরের ধাপে একের পর এক অর্গান ফেইল করা শুরু করবে!প্রথমে ব্রেইন এর নিউরোন গুলো ড্যামেজ হবে – এর পর আমাদের লিভার ও রক্রনালীর সেল গুলোর ড্যামেজ শুরু হবে।পরিশেষে সব অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ ধীরে-ধীরে কার্যক্ষমতা হারাবে।রুগী এই অবস্থায় পৌঁছে গেলে উপরের স্টেপ গুলো তো নিতে হবেই – যত দ্রুত সম্ভব আইসিইউ আছে এমন হাসপাতালে পাঠানোর ব্যবস্থা করতে হবে।
তবে রুগীকে ঢাকা পাঠানোর নামে আরো দশ ঘন্টা গরমের মধ্যে ঢাকার পথে ট্রাফিক জামে ফেলে রাখার কোন মানে হয় না।
আপনার স্থানীয় ঔষধের দোকানের স্বত্বাধিকারীকে বলুন কিছু স্যালাইন এর ব্যাগ ফ্রিজে রেখে দিতে (ডিপ ফ্রিজ নয়)।রুগীকে ওই ঠান্ডা স্যালাইন শিরায়(intravenous) দিতে পারলেও অনেক কাজ হবে।
তবে মূল লক্ষ্য টা হবে কেউই যাতে হিট এক্সহশন পর্যায়ে না যায়।ঘরের বাইরে যেতে হলে – সাথে বড় ঠান্ডা পানির ফ্লাস্ক বা বোতল রাখুন এবং কিছু পরপর পানি খেয়ে মুখ ভিজিয়ে রাখুন।
শিশুরা যারা বাইরে স্কুলে যায়,মাঠে দৌড়া দৌড়ি করে তাদের কে স্কুলে না পাঠানোই ভালো।স্কুলে তো আর এসি নেই! বেশি রিস্কি গরম পড়লে স্কুল বন্ধ করে দেয়াই ভালো।
যত হালকা পাতলা খোলামেলা পোশাক পরা যায় তত ভালো।তবে আমাদের ধর্মীয় রক্ষণশীল সমাজে মহিলাদের জন্য এই এডভাইস টা তো প্র্যাকটিকাল না।ওনাদের এই সময়গুলোতে ঘরের বাইরে বের না হওয়াটাই নিরাপদ।আরেকটা কথা মহিলারা কিন্তু ঘরের ভিতরে রান্না ঘরে একটা রিস্কি এনভায়রনমেন্ট আছেন।গরমের দিন রান্না ঘরের তাপমাত্রা অন্যান্য রুমের চেয়ে অনেক বেশি।এই ব্যাপারটাও অনুগ্রহ করে মাথায় রাখবেন।
ডাঃ মোঃ আবুয়াল হাসান
এফসিপিএস(মেডিসিন)
কনসালটেন্ট (মেডিসিন)
জেলা সদর হাসপাতাল,ঝালকাঠী।